ইমামের পিছনে সূরা ফাতিহা পাঠ করা




ইমামের পিছনে সূরা ফাতিহা পাঠ করা

*প্রশ্নঃ* আমাদের দেশে ইমামের পিছনে সূরা ফাতিহা পড়ার তিনটি মতামত প্রচলিত আছে, ক) ইমাম কিরআত মনে মনে পড়ুক বা উচ্চস্বরে পড়ুক মুক্তাদিকে মনে মনে সূরা ফাতিহা পড়তে হবে, খ) ইমাম সাহেব যখন কিরআত উচ্চস্বরে পড়েন তখন মুক্তাদিকে সূরা ফাতিহা পড়া লাগবে না, ইমামের তিলাওয়াত শুনলেই চলবে, তবে ইমাম মনে মনে সূরা পড়লে সেক্ষেত্রে মুক্তাদিকেও সূরা ফাতিহা পড়া লাগবে, গ) ইমাম কিরআত মনে মনে পড়ুক বা উচ্চস্বরে পড়ুক কোনো অবস্থাতেই মুক্তাদির সূরা ফাতিহা পড়া লাগবে না, ইমামের তিলাওয়াতই সবার জন্য যথেষ্ট হবে।

সর্বশেষ মতটিকে আবার ইমাম আবু হানিফার (রহিমাহুল্লাহ্) মত বলে বলা হয়৷ এটি কতটুকু সঠিক❓উপরের তিনটি মতামতের কোনটি অধিক যুক্তিযুক্ত ও সহীহ্❓

*উত্তরঃ* জী, এই তিনটি বক্তব্য সঠিক; এখানে শুধু তিনটি বক্তব্য নয়, আরো অনেকগুলো বক্তব্য রয়েছে তবে এই তিনটিই প্রসিদ্ধ। সর্বশেষ আপনি যে বক্তব্যটি উল্লেখ করেছেন যে, ইমাম কিরআত সরবে পড়ুক অথবা নিরবে পড়ুক দুই অবস্থাতেই সূরা ফাতিহা পড়তে হবে না। জী, এ ব্যাপারে ইমাম আবু হানিফার (রহিমাহুল্লাহ্) রেওয়াত সাব্যস্ত হয়েছে, ইমাম আবু হানিফার (রহিমাহুল্লাহ্) ইজতিহাদ হচ্ছে এক্ষেত্রে মুক্তাদিকে সূরা ফাতিহা পড়তে হবে না। কারণ, তিনি এখানে কুরআনে কারীমের একটি আয়াতের উপর নির্ভর করেছেন। আয়াতটি হচ্ছে,

*وَإِذَا قُرِئَ ٱلْقُرْءَانُ فَٱسْتَمِعُوا۟ لَهُۥ وَأَنصِتُوا۟ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ*

"যখন কুরআন তিলাওয়াত করা হয়ে থাকে তখন তোমরা কুরআনকে শুনবে এবং চুপ থাকবে।" (সূরা আল আ'রাফ ২০৪)

কুরআনে কারীমের এই নির্দেশনাকে তিনি সলাত এবং সলাতের বাইরে সর্বাবস্থায় কমন করে দিয়েছেন তাই তিনি বলেছেন সূরা ফাতিহা পড়তে হবেনা। তবে এই ইজতিহাদটুকু যথাযথ হয়নি এজন্য যেহেতু সূরা ফাতিহা পড়ার ব্যাপারে সুনির্দিষ্টভাবে দলিল রয়েছে৷ আমাদের জানতে হবে দলিল দুই প্রকার। যদিও এটি একাডেমিক বিষয় তারপরও যেহেতু প্রশ্ন এসেছে, আমরা বলছি। দলিল দুই প্রকারঃ

১. দলিলুল খুসুস বা খাস দলিল।

২. দলিলুল 'উমুম বা 'আম দলিল।

*দলিলুল খুসুসঃ* দলিলুল খুসুস বলা হয়ে থাকে সুনির্দিষ্ট বিষয়ে সুনির্দিষ্ট দলিল পাওয়া যাওয়াকে।

*দলিলুল 'উমুমঃ* দলিলুল 'উমুম বলা হয়ে থাকে এমন দলিলকে যেটি ব্যাপক অর্থ বুঝায় এবং যার মধ্যে অনেক কিছু অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকে। হতে পারে যে কোনো ক্ষেত্রে দলিলুল 'উমুমের মধ্যে কোনো ক্ষেত্রে তাখসীস ও থাকতে পারে আবার তাক্বীদও থাকতে পারে৷

*তাখসীসঃ* তাখসীস হচ্ছে দলিলে 'উমুম থেকে বা ব্যাপকতা থেকে একটি জিনিসকে বাহির করে দেয়া বা বিশেষভাবে উল্লেখ করা।

*তাক্বীদঃ* তাক্বীদ হচ্ছে ঐ 'উমুমকে বা ব্যাপকতাকে আবার কোনো একটি বক্তব্যের মাধ্যমে শর্তসাপেক্ষে নির্ধারণ করে দেয়া।

সুতরাং ফিকহের পরিভাষায় 'উমুমের উপর সবসময় তাক্বীদ অথবা তাখসীস দুটিই হতে পারে।

কিন্তু দলিল খুসুস বা সুনির্দিষ্ট দলিল যখন সুনির্দিষ্ট বিষয়ের উপর আসবে তখন এটিকে আর তাখসীস করার সুযোগ থাকে না।

সূরা ফাতিহা পড়ার ব্যাপারে দলিল খুসুস এসে এসেছে বা সুনির্দিষ্ট দলিল এসেছে; একটি দুটি হাদিস নয় অনেকগুলো হাদিসের মধ্যে রাসূলুল্লাহ্ ﷺ সূরা ফাতিহা পড়ার ব্যাপারে স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন। উবাদা ইবনে সামিত রাদি'আল্লাহু তা'আলা 'আনহু বর্ণিত হাদিসে রাসূলুল্লাহ্ বললেন,

*ما لي ينازعني القرآن*

আমি কি কুরআন নিয়ে তোমাদের সাথে ঝগড়া শুরু করেছি যে তোমরা আমার পিছনে কুরআন তিলাওয়াত করতেছো। রাসূলুল্লাহ্ ﷺ সাহাবীদের জিজ্ঞেস করলেন তোমরা কি আমার পিছনে কুরআন তিলাওয়াত কর? সাহাবায়ে কিরাম বললেন, *نعم يا رسول الله* জী, ইয়া রাসূলুল্লাহ্ আমরা আপনার পিছনে কুরআন তিলাওয়াত করে থাকি। তখন রাসূলুল্লাহ্ ﷺ বললেন *لا تفعلوا* খবরদার তোমরা কুরআন তিলাওয়াত করো না। এখানে যদি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লালাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম *لا تفعلوا* বলে চুপ হয়ে যেতেন তাহলে কোনো অসুবিধা ছিল না। কিন্তু রাসূলুল্লাহ্ ﷺ বললেন, *لا تفعلوا إلا بفاتحة الكتاب* "এই কাজটি করবেনা শুধুমাত্র সূরা ফাতিহা ছাড়া।" (নাসাঈ, বাইহাকি, আহমাদ)

এই হাদিসটি দুইজন সাহাবী থেকে বর্ণিত হয়েছে 'উবাদাহ ইবনে সাবিত রাদি'আল্লাহু তা'আলা 'আনহু থেকে ও আবু সাঈদ খুদরি রাদি'আল্লাহু তা'আলা 'আনহু থেকে এবং তারা দুজনই বলেছেন এটা ফযরের সলাতের মধ্যে ছিল। রাসূলুল্লাহ্ ﷺ বলেছেন সূরা ফাতিহা ছাড়া আর কোনো কিরআত আমার পিছনে পড়বে না।

যেহেতু রাসূলুল্লাহ্ ﷺ স্পষ্ট করে দিয়েছেন সূরা ফাতিহা পড়ার ব্যাপারে আর এটিকেই বলা হয়ে থাকে দলিলুল খুসুস বা সুনির্দিষ্ট দলিল। যেহেতু এখানে সূরা ফাতিহা পড়ার ব্যাপারে দলিলুল খুসুস এসে গিয়েছে সুতরাং সূরা ফাতিহা পড়তে হবে। সূরা ফাতিহা পড়ার ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ্ ﷺ একাধিক হাদিসের মধ্যে স্পষ্ট করে দিয়েছেন,

*لاَ صَلاَةَ لِمَنْ لَمْ يَقْرَأْ بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ*

"যে সূরা ফাতিহা পড়লো না, তার সলাতই হবে না।" (বুখারি, মুসলিম)

এই ফাতাওয়া কিন্তু কোনো ব্যক্তি তৈরি করেননি, দুনিয়ার কোনো 'আলিম তৈরি করেননি, এটি দুনিয়ার কোনো মুফতির বক্তব্য নয়, দুনিয়ার কোনো বুজুর্গের বক্তব্য নয়, সরাসরি আল্লাহর রাসূল ﷺ এর হাদিস যে, সূরা ফাতিহা যদি কেউ না পড়ে তাহলে তার সলাতই হবে না।

সুতরাং, এক্ষেত্রে আমাদের সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে, যেহেতু সহীহ্ হাদিস দ্বারা প্রমাণ হয়েছে সেহেতু সূরা ফাতিহা পড়াই হচ্ছে বিধান এবং সূরা ফাতিহা রাসূল ﷺ পড়তে বলেছেন। ফলে এ ব্যাপারে আবু হুরাইরা রাদি'আল্লাহু তা'আলা 'আনহুকে যখন জিজ্ঞেস করা হল যে, ইমাম যখন জোরে জোরে কিরআত পড়ে তখন আমরা কিভাবে সূরা ফাতিহা পড়বো? তখন আবু হুরাইরা রাদি'আল্লাহু 'আনহু বললেন *إقرأ بنفسك* তুমি মনে মনে পড়বে। তাহলে বুঝা গেল যে সাহাবায়ে কিরাম রাদি'আল্লাহু তা'আলা 'আনহুম এ বিষয়ের উপর যখন প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছেন তখন এর সমাধান কি সেটিও তাদের হাদিসের মাধ্যমে, তাদের বক্তব্যের মাধ্যমে স্পষ্ট করেছেন।

তাই এক্ষেত্রে ইমাম আবু হানিফা (রহিমাহুল্লাহ্) যে ইজতিহাদটি উল্লেখ করেছেন এটি মূলত দলিলুল 'উমুম বা 'আম দলিলের উপর ছিল কিন্তু দলিলুল খুসুস বা সুনির্দিষ্ট দলিল থাকার কারণে এক্ষেত্রে সূরা ফাতিহা পড়ার বিষয়টিই বিশুদ্ধ রেওয়াতের মাধ্যমে সাব্যস্ত হয়েছে৷

▬▬▬🔹♦🔹▬▬▬

*উত্তর দিয়েছেন, শাইখ ড. মুহাম্মাদ সাইফুল্লাহ্ (হাফিযাহুল্লাহ্)*

*[এনটিভির "আপনার জিজ্ঞাসা" প্রোগ্রাম থেকে নেয়া]*

Post a Comment

[blogger][facebook][disqus]

MKRdezign

Contact Form

Name

Email *

Message *

Powered by Blogger.
Javascript DisablePlease Enable Javascript To See All Widget