রিয়া: একটি আমল বিধ্বংসী ভয়ানক ব্যাধী

রিয়া: একটি আমল বিধ্বংসী ভয়ানক ব্যাধী
(রিয়া সংক্রান্ত একটি বিশ্লেষণধর্মী আলোচনা)
▬▬▬▬●◈●▬▬▬▬
☑ রিয়া কাকে বলে?
- রিয়া শব্দের অর্থ: প্রদর্শন, আত্মপ্রদর্শন, ভান, কপটতা, মোনাফেকি, ভণ্ডামি।
- শরিয়তের পরিভাষায়, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্য ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্যে বা অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য বা দুনিয়াবী স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে কোন ইবাদত করা হলে তাকে ‘রিয়া’ বলা হয়।
রিয়া ছোট শিরকের পর্যায়ভুক্ত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
( إِنَّ أَخْوَفَ مَا أَخَافُ عَلَيْكُمْ الشِّرْكُ الْأَصْغَرُ . قَالُوا : وَمَا الشِّرْكُ الْأَصْغَرُ يَا رَسُولَ اللَّهِ ؟ قَالَ : الرِّيَاءُ ‌

“আমি তোমাদের উপর আমি সর্বাপেক্ষা ভয়
করছি ছোট শিরক সম্পর্কে।” অতঃপর এ সম্পর্কে সাহাবীগণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে প্রশ্ন করলেন, হে আল্লাহর রাসূল, ছোট শিরক কী?
তিনি বলেন, “তা হল রিয়া তথা লোক দেখানো কর্ম বা ইবাদত।”
অতঃপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার ব্যাখ্যা করে বলেন, “কোন মানুষ সালাত আদায়ের জন্য দাঁড়াল, যখন দেখল লোকজন তাকে দেখছে তখন সালাতকে আরও সুন্দরভাবে আদায় করল।” (ইবনে মাজাহ্‌, হাকেম-সহীহুল জামে হা/১৫৫৫)

এটি শিরকের অন্তর্ভুক্ত। কেননা উক্ত ব্যক্তি আল্লাহ্‌কে সন্তুষ্টি করা ছাড়া মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করাকেই তার ইবাদতের উদ্দেশ্যে পরিণত করেছে। কখনও এমন কাজ বড় শিরকের পর্যায় পৌঁছতে পারে।

▬▬▬▬▬▬▬▬
☑ যে ইবাদত রিয়া মিশ্রিত হয় তা তিন প্রকার:
🔰 প্রথম প্রকার: ইবাদত মূলত: লোক দেখানোর উদ্দেশ্যেই করা হয়। যেমন মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য সালাত আদায় করা। ইহা শিরক এবং এ প্রকার ইবাদত বাতিল।
🔰 দ্বিতীয় প্রকার: ইবাদত করার মধ্যবর্তী অবস্থায় রিয়ায় পতিত হওয়া। অর্থাৎ- যেমন ইবাদত শুরুর সময় মুখলিসভাবে আরম্ভ করে কিন্তু ইবাদতের মধ্যবর্তী সময়ে রিয়া মিশ্রিত হয়।
এ অবস্থায় ইবাদতের প্রকারভেদ অনুযায়ী তার হুকুম নির্ধারিত হবে। যেমন,
🔸 (১) যদি দ্বিতীয় ইবাদতটি ১মটির উপর ভিত্তিশীল না হয় তবে প্রথমটি শুদ্ধ হবে আর দ্বিতীয়টি বাতিল হয়ে যাবে। এর উদাহরণ হল, যেমন কোন ব্যক্তি একশত রিয়াল দান করল ইখলাসের সাথে, আরও একশত রিয়াল দান করল লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে, এমতাবস্থায় প্রথম একশত রিয়াল দানটি শুদ্ধ হবে। আর দ্বিতীয় একশত রিয়াল দানটি বাতিল হয়ে যাবে।
🔸 (২) যদি ইবাদতটির শেষাংশ প্রথমাংশের উপর ভিত্তিশীল হয় তবে এর দুটি অবস্থা। যথা:
▪ (ক) ইবাদত কারী ব্যক্তি রিয়াকে প্রতিহত করবে এবং রিয়ার উপর স্থির হবে না। যেমন কোন ব্যক্তি সালাতে দাঁড়াল মুখলিছভাবে কিন্তু দ্বিতীয় রাকাত কালীন স্বীয় অন্তরে রিয়া অনুভব করল, অতঃপর সালাত আদায়কারী স্বীয় অন্তরে রিয়া অনুভব করতে থাকল, এমতাবস্থায় রিয়া ইবাদতে কোন প্রকার প্রভাব ফেলবে না, অথবা কোন ক্ষতিও করবে না।
▪ (খ) অপর অবস্থাটি হল: ইবাদত কারী রিয়ার প্রতি তুষ্ট থাকবে এবং রিয়াকে অন্তরে প্রতিহত করবে না। এমতাবস্থায় তার পূর্ণ ইবাদতটি বাতিল হয়ে যাবে। কেননা ইবাদতের শেষাংশ প্রথমাংশের উপর ভিত্তি শীল। যেমন কোন ব্যক্তি সালাতে দাঁড়াল ইখলাসের সাথে, অতঃপর দ্বিতীয় রাকাতে সে যখন লক্ষ্য করল মানুষ তার সালাতের দিকে দৃষ্টি দিয়েছে, তখন তার অন্তরে রিয়ার উদয় হল এবং সালাত রত উক্ত ব্যক্তি রিয়ার প্রতি তুষ্ট থাকল (অন্তরে রিয়াকে প্রতিহত করল না) এমতাবস্থায় পূর্ণ সালাত বাতিল হয়ে যাবে। কেননা সালাতের শেষাংশের সাথে প্রথমাংশ সম্পৃক্ত রয়েছে।

🔰 তৃতীয় প্রকার: ইহা হল ইবাদত সমাপ্ত করার পর যদি ইবাদত কারীর অন্তরে রিয়ার উদ্ভব ঘটে, তবে তা ইবাদতে কোন প্রকার প্রভাব ফেলবে না। কিন্তু যদি ইবাদতের সাথে সংঘর্ষকারী কিছু করে তবে ইবাদতটি বাতিল হয়ে যাবে। যেমন দান খয়রাত করার পর দান গ্রহণকারীকে খোঁটা দেয়া, গনা করা বা এ প্রকার কোন দুঃখ-কষ্ট ইত্যাদি দেয়া।
▬▬▬▬▬▬▬▬

☑ নিম্নোক্ত বিষয়গুলো রিয়ার অন্তর্ভুক্ত নয়:
(১) সুন্দর পোশাক পরিধান করা বা মানুষের সম্মুখে সৌন্দর্য প্রকাশ করা ।
(২) পাপ গোপন করা বা তা প্রকাশ না করা।
(৩) ইবাদত কারীকে দেখে ইবাদতের প্রতি উৎসাহ-উদ্দীপনা বৃদ্ধি পাওয়া।
(৪) কোন কাজ ইখলাসের সাথে করার পর মানুষ তার প্রশংসা করলে খুশি হওয়া। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: تلك عاجل بشرى المؤمن “ইহা মুমিনদের আশু শুভ সংবাদ।”
(৫) যদি কেউ আল্লাহর সন্তষ্টির জন্য ইখলাসের সাথে কোন কর্ম সম্পাদন করে, অতঃপর উক্ত কাজের জন্য অর্থ সম্পদ গ্রহণ করে। যেমন কোন মুজাহিদকে গণিমতের সম্পদ হতে বা নির্ধারিত বেতন-ভাতা প্রদান করা হয় বা আল্লাহর পথে আহ্বানকারী (দাঈ) কিছু অর্থ-কড়ি ভাতা হিসাবে গ্রহণ করে, যা তার ধর্মীয় দাওয়াতের জন্য সহায়ক। এরকম বেতন-ভাতা গ্রহণ কোন ক্ষতি করে না। কেননা একব্যক্তি তার কর্ম দ্বারা দ্বীনের খিদমত করছে, আর তার ভাতা যা গ্রহণ করছে তা তার দীনী কর্মে সহায়ক।
এজন্যই যারা ধর্মীয় ও পার্থিব কল্যাণ করেন, তাঁদের জন্য আল্লাহ্‌ তায়ালা ইসলামী শরীয়তে বিধান রেখেছেন, যেন তারা যাকাত ও যুদ্ধ লভ্য সম্পদ (গণিমত) হতে একটি বিরাট অংশ গ্রহণ করতে পারেন।
আর যদি কোন ব্যক্তি আল্লাহর সন্তষ্টি ও পার্থিব উন্নতির উদ্দেশ্যে কোন কর্ম সম্পাদন করে এবং উক্ত উভয় বিষয়ের উদ্দেশ্যই সমান থাকে, তবে উক্ত ব্যক্তির আমলটি ত্রুটিপূর্ণ হবে। কেননা সে ব্যক্তির নিয়তে পুর্ণ ইখলাস নেই এবং তার ঈমানও অসম্পূর্ণ।
আর যদি কেউ শুধু দুনিয়ার উদ্দেশ্যে কর্ম করে, তা হলে ঐ ব্যক্তির জন্য পরকালে পাবার কিছুই থাকবে না। আর এ ধরণের উদ্দেশ্যে কোন কর্ম মুমিন ব্যক্তি হতে হয় না।
(৬) ইবাদতের সাথে অন্য কোন উদ্দেশ্য মিলিত করণ:
যেমন কেউ জিহাদ করে আল্লাহর আনুগত্য ও গণিমতের সম্পদ অর্জনের উদ্দেশ্যে। অথবা হজ্ব করার সাথে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য একত্রিত করে, বা সিয়াম পালন করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ও স্বাস্থ্য রক্ষার উদ্দেশ্যে। এসকল উদ্দেশ্যের মধ্যে কোন সৃষ্ট জীব বা বস্তুর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হয় না, বরং ইবাদতের সাথে কিছু কল্যাণকর বিষয়কে একত্রিত করা হয়েছে। এসকল উদ্দেশ্য একত্রিত করার ফলে কখনও সওয়াব কম হতে পারে। আর যদি ইবাদত এসব বিষয় মুক্ত হয় তখন সওয়াব আরও অধিক হবে।
(৭) কোন ব্যক্তি যদি এমন কিছু করে যা দেখে লোকজন অনুসরণ করতে পারে, তবে ঐ কাজটি রিয়ার অন্তর্ভুক্ত হবে না। বরং তা এক ধরণের দাওয়াতের অন্তর্ভুক্ত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
فعلت هذا لتأتموا بى و تعلموا صلاتى-(متفق عليه
“আমি এরূপ করলাম যেন তোমরা আমার অনুসরণ করতে পার এবং আমার সালাত শিক্ষা গ্রহণ করতে পার।” (বুখারী ও মুসলিম)
▬▬▬▬▬▬▬▬

☑ কর্মের মাধ্যমে পার্থিব উদ্দেশ্য অর্জনের স্বরূপ নির্ণয়কারী কতিপয় উদাহরণ:
(১) শুধু অর্থ-সম্পদ অর্জন উদ্দেশ্য করা: যেমন কেউ আজান দেন শুধু বেতন পাওয়ার জন্য অথবা বদলী হজ্ব করেন টাকা অর্জনের জন্য ইত্যাদি।
(২) শুধু মর্যাদা অর্জনের জন্য কিছু করা: যেমন কেউ শিক্ষা গ্রহণ করে শুধু সার্টিফিকেট অর্জনের লক্ষ্যে যেন এর মাধ্যমে তার মর্যাদা বৃদ্ধি পায়।
(৩) কষ্ট, বিপদ বা অসুস্থতা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ইবাদত করা: যেমন কেউ ইবাদত করে যেন এর বিনিময়ে আল্লাহ্‌ তার কষ্ট দূর করে দেন, বা বিপদ হতে রক্ষা করে বা রোগমুক্ত করেন ইত্যাদি।
(৪) জনপ্রিয়তা ও মানুষের ভালবাসা পাবার উদ্দেশ্যে ইবাদত করা।
▬▬▬▬▬▬▬▬

☑ কিছু কাজ আছে যেগুলো সূক্ষ্ম রিয়ার পর্যায়ভুক্ত।
নিম্নে তার কিছু উদাহরণ প্রদান করা হল:
▪(ক) যেমন কোন লোক আল্লাহর আনুগত্য (ইবাদত) গোপনে করছে এবং সে তা প্রকাশ করতে চায় না। কিন্তু যখন মানুষ জেনে যায়, তখন উক্ত আমলকারী চায় মানুষ যেন তাকে সম্মানের সাথে সালাম করে। তার সাথে হাঁসি মুখে যেন উত্তম আচরণ করে। (যেহেতু তিনি ইবাদত কারী) ইত্যাদি।
▪(খ) যেমন কোন মানুষ ইখলাসের সাথে কিছু কাজ করে এজন্য যে,সে যেন আলেম হতে পারে, বা জ্ঞানী হতে পারে, বা আধ্যাত্মিক হতে পারে, অথবা মানুষের সম্মান ও প্রশংসা অর্জন করতে পারে ইত্যাদি।এমন ব্যক্তি তার ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি চায় না। বরং তার সামান্য উদ্দেশ্য সাধনে আল্লাহর ইবাদতকে মাধ্যম হিসাবে নির্ধারণ করেছে।
▪ (গ) মানুষের সামনে নিজকে ভর্ৎসনা করা, যেন মানুষের নিকট সম্মান বৃদ্ধি পায় অথবা মানুষ তার প্রশংসা করে।
▬▬▬▬●◈●▬▬▬▬
উৎস: তাওহীদ, লেভেল-৩ (জুবাইল দাওয়াহ সেন্টারের পাঠ্যপুস্তক)
অনুবাদক: শাইখ আব্দুল্লাহ আল কাফী বিন আব্দুল জলীল মাদানী
সম্পাদনা: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল মাদানী

Post a Comment

[blogger][facebook][disqus]

MKRdezign

Contact Form

Name

Email *

Message *

Powered by Blogger.
Javascript DisablePlease Enable Javascript To See All Widget